December 15, 2021

বাংলা গানের ইতিহাসে নজরুল ইসলাম, রবীন্দ্রনাথ, রজনীকান্ত, মান্না দে, অতুলপ্রসাদ সেনের অবদান |

বাংলা গানের ইতিহাসে/ধারায় কাজী নজরুল ইসলামরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, রজনীকান্ত সেন, মান্না দে, অতুলপ্রসাদ সেনের ভূমিকা। বাংলা গানের ইতিহাস দ্বাদশ শ্রেণি নোটস সঙ্গে PDF. 

বাংলা গানের ইতিহাস/ধারায়

বাংলা গানের ধারায় কাজী নজরুল ইসলামের অবদান লেখ

কাজী নজরুল ইসলাম


সংগীত জগতে কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন এক অসাধারণ প্রতিভার স্রষ্ঠা। গীতিকাব্য ও সুরকার হিসেবে তাঁর খ্যাতি ও জনপ্রিয়তা ছিল আকাশস্পর্শী। তার লেখা কাব্যের ও গানে আরবি-ফারসি সহ ভারতীয় ও বাঙালি সংস্কৃতির মিশ্রণ ঘটায় বাংলা গানের ক্ষেত্রে আসে অভূতপূর্ব বৈচিত্র, নব নব আস্বাদন।

নজরুলের গানকে কয়েকটি পর্যায়ে ভাগ করা যায়। যথা-

 প্রেম ও প্রকৃতিঃ- নজরুলের অধিকাংশ গানের বিষয় ভাবনা প্রেম ও প্রকৃতি প্রধান। তাঁর প্রেম সঙ্গীতগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল-মোর প্রিয়া হবে এসো রানী”।

স্বদেশ সংগীতঃ- নজরুলের লেখা স্বদেশী সংগীতগুলি তার কবিতার মতো শাসক ইংরেজদের রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছিল। তার “কারার ঐ লৌহ কপাট” অথবা “দুর্গম গিরি কান্তার-মরু” গানগুলি ছিল সে সময়ে বিপ্লবীদের জীবনসঙ্গী।

ঋতু সংগীতঃ- নজরুলের বহু গানেই ঋতুর প্রসঙ্গে এসেছে। তাঁর লেখা ঋতু সংগীত গুলির মধ্যে “এসো শরদ প্রাতের পথিক” বিশেষ উল্লেখযোগ্য।

গজলঃ- মধ্যপ্রাচ্যে গজল অনুসারে আরবি-ফারসি শব্দ ব্যবহারে তৈরি নজরুলের লেখা বাংলা গজলগুলি রসসিদ্ধ হয়েছিল। যেমন- “গুলবাগিচার বুলবুলি আমি”।

হাস্যগীতিঃ- কাজী নজরুল ইসলাম বেশকিছু হাসির গানও লিখেছেন। “আমার হরিনামের রুচি কারন পরিণামের লুচি” গানটি প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য।

এছাড়াও তিনি আরও গান লিখেছেন। যেমন- ভক্তিগীতি (খেলিছ এ বিশ্ব লয়ে) ইসলামিক (ত্রিভুবনের প্রিয় মোহাম্মদ) শিশু সংগীত (প্রজাপতি প্রজাপতি) ভাটিয়ালি (একুল ভাঙ্গে ওকুল গড়ে, এইতো নদীর খেলা) ইত্যাদি। বাংলা গানের যাত্রাপথের নজরুল ইসলাম নামটি তাই অবিস্মরনীয়।

 

বাংলা গানের ধারায় রবীন্দ্রনাথের অবদান লেখ

 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা গানের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় নামে। তাঁর রচিত গানের সংখ্যা দুই সহস্রাধিক। এই সুবিপুল সঙ্গীত ভান্ডার যেমন সমৃদ্ধ তেমনই বৈচিত্র্যপূর্ণ। বাংলা মানুষের আনন্দ, দুঃখ, প্রেম, প্রতিবাদ, প্রকৃতি মুগ্ধতা, দেশপ্রেম, ঈশ্বর উপলব্ধি সমস্ত কিছুই প্রকাশ যাকে আশ্রয় করে তা হল রবীন্দ্রনাথ এবং তার গান, রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং তার ‘গীতবিতান’ গ্রন্থের সৃষ্ট সংগীতকে বিষয় অনুযায়ী প্রেম, স্বদেশ, প্রকৃতি ইত্যাদি বিভিন্ন পর্যায়ে ভাগ করেছেন।

প্রেম সংগীতঃ- রবীন্দ্রনাথের প্রেম সংগীতের সংখ্যা প্রচুর, প্রায় সাড়ে চারশ। তার প্রেম সংগীতের মধ্যে উল্লেখযোগ্য গান হল- “আমি তোমারও সঙ্গে বেঁধেছি আমার প্রাণ”।

দেশাত্মবোধকঃ- মূলত তিনি বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় দেশাত্মবোধক গান রচনা করেন। এই ধরনের গানের সংখ্যা মোট 62 টি। ভারতবর্ষের জাতীয় সংগীত “জনগণমন-অধিনায়ক জয় হে” এবং বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত “আমার সোনার বাংলা” তারই রচনা। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন গৌরব আর কোন কবি বা গীতিকারের নেই।

প্রকৃতি বিষয়কঃ- রবীন্দ্রনাথের বহু গানেই প্রকৃতির বর্ণনা সমধিক পরিমাণে। বহু গান সরাসরি বিভিন্ন ঋতু কে উদ্দেশ্য করে রচিত। যেমন- “এসো এসো বাসন্ত ধরাতলে”।

শিশু সংগীতঃ- রবীন্দ্রনাথের অনেকগুলি গান শিশুদের উপযোগী। যেমন- “মেঘের কোলে রোদ হেসেছে”।

কবিতার গানঃ- রবীন্দ্রনাথের কিছু গান প্রথমে কবিতা হিসেবে লিখিত হয়, পরে সুর সংযোজিত হয়ে গানের রূপান্তরিত হয়েছে। যেমন- “খাঁচার পাখি ছিল সোনার খাঁচাটিতে”।

আনুষ্ঠানিক সঙ্গীতঃ- শান্তিনিকেতনে আশ্রমিক জীবনের নানা উৎসব অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে রবীন্দ্রনাথ বহু গান রচনা করেন। যেমন- “আমরা চাষ করি আনন্দে”।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা গান বাংলা গানের ইতিহাসে এক কালোত্তীর্ণ অধ্যায়। তার গান বাংলা তথা ভারতে মূল্যবান সম্পদ। তাই বাংলা গানের যাত্রা পথে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামটি আজও স্মরণীয় হয়ে আছে।

 

বাংলা গানের ধারায় রজনীকান্ত সেনের ভূমিকা লেখ

রজনীকান্ত সেন



‘কান্তকবি’ নামে পরিচিত রজনীকান্ত সেন বাংলা গানের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় নাম। তিনি বাল্যকাল থেকেই ছিলেন সঙ্গীতপ্রিয়। তাঁর বাবা গুরুপ্রসাদ সেন ছিলেন এক দক্ষ সঙ্গীতজ্ঞ। রজনীকান্ত এই সূত্রে সঙ্গীত চর্চা শুরু করেন। “বানী ও কল্যাণী” গ্রন্থদ্বয়ে তাঁর গানগুলি সংকলিত হয়েছে। তাঁর সৃষ্ট গীতসংগীত কে ভক্তিগীতি, স্বদেশী গান ও হাস্যরসে গানে ভাগ করা যেতে পারে।

ভক্তিগীতিঃ- বানী, সুর, ভাব,‌ কাব্যমাধুর্, স্বকীয়তা এবং সহজ চলনে তার লেখা ভক্তিগীতিগুলি বাংলা গানের ভুবনে বিশিষ্ট হয়ে আছে। যেমন- “তুমি নির্মলো কর মঙ্গলো করে মলিনো মর্ম মুছায়ে”।

স্বদেশ গীতিঃ- রজনীকান্ত অসামান্য কিছু দেশাত্মবোধক গানের রচয়িতা। 1905 খ্রিস্টাব্দে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় তাঁর “গান মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নে রে ভাই” তাকে এক অসামান্য গীতিকার রূপে প্রতিষ্ঠা এনে দেয়।

হাস্য গীতিঃ- রজনীকান্ত বেশ কিছু হাসির গানও রচনা করেন। যেমন- “যদি কুমড়োর মত চালে ধরে রত” এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য।

    রজন্তীকান্তের লেখা গান বাংলা তথা ভারতে এক কালোত্তীর্ণ অধ্যায়। তিনি সংগীতকার হলেও একজন কবি ছিলেন। তাঁর গান প্রসিদ্ধি লাভ করেছে “কান্তগীতি” নামে। তাঁর গানগুলি আজও বাঙালি শ্রোতাকে মুগ্ধ করে। তাঁর ভক্তিমূলক গানের আত্মনিবেদনের আকৃতি আজও বাঙালির শ্রোতার মনেপ্রানে গেঁথে আছে।

 

বাংলা গানের ইতিহাসে মান্না দের অবদান লেখ

 

মান্না দে

সুর সম্রাট মান্না দে আধুনিক বাংলা গানের স্বর্ণযুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত শিল্পী। তাঁর আসল নাম প্রবোধ চন্দ্র দে। ডাকনাম মানা, মুম্বাইয়ের অবাঙালীদের উচ্চারণে মানা হয়ে যায় মান্না।

       শৈশবে কাকা সঙ্গীতাচার্য কৃষ্ণচন্দ্র দের কাছে এবং পরে ওস্তাদ দবীর খাঁর কাছে তিনি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের তালিম প্রাপ্ত হন। 1942 খ্রিস্টাব্দে ‘তামান্না' ছবিতে সুরাইয়ার সঙ্গে গাওয়া ‘জাগো আইয়ি ঊষা’ গানটি মধ্যে দিয়ে তাঁর শিল্পী হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘট।

      সব ধরনের গানের ক্ষেত্রে মান্নাদে ছিলেন সিদ্ধহস্ত। “সুন্দরি গো দোহাই তোমার” প্রভৃতি রোমান্টিক গানে তিনি যেমন মানুষের হৃদয়কে স্পর্শ করেছেন। তেমনি “বাঁচাও কে আছো মোরে” কৌতুক রংমিশ্রিত সঙ্গীতের মাধ্যমেও তিনি সৃষ্টি করেছেন চিরন্তন আবেদন। অথবা “জীবনটাই ভাই ওয়ানডে ক্রিকেট” বা “সব খেলার সেরা বাঙালির তুমি ফুটবল” প্রভৃতি গানগুলি খেলোয়ারদের কাছে যেন এক একটি শ্লোগান বিশেষ। আবার ‘কফি হাউজের সেই আড্ডা'র’ মতো মর্ম বিধায়ক গান যেন সারা জীবনের সম্পদ। সেইসঙ্গে নজরুলগীতি, ভক্তিগীতি, রবীন্দ্রসংগীতও তিনি গেয়েছেন অজস্র। অন্যান্য ভাষার মধ্যে হিন্দি, মারাঠি, গুজরাটি ছাড়াও পাঞ্জাবি, উড়িয়া, ভোজপুরি প্রভৃতি ভাষাতেও তিনি গান গেয়েছেন।

       মান্নাদে তার সুদীর্ঘ কর্মজীবনে সুরের ভুবন কে আলোকিত করার স্বীকৃতরূপে অর্জন করেন নানা খ্যাতি, পুরস্কার ও সম্মান। 1971 তে “পদ্মশ্রী”, 2005 এর “পদ্মবিভূষণ”, 2007 এ “দাদাসাহেব ফালকে” প্রভূতি।

 98 বছর বয়সে তিনি প্রয়াত হলেন ঠিকই, কিন্তু সুরসপ্তকের অধিরাজ রূপে তার অবদান সংগীত কলার ইতিহাসের চির ভাস্কর্য হয়ে থাকল।

 

বাংলা গানের ইতিহাসে অতুলপ্রসাদ সেনের ভূমিকা

অতুলপ্রসাদ সেন


    বাংলা গানের অন্যতম গীতরচয়িতা এবং সুরকার অতুলপ্রসাদ সেন। অতুলপ্রসাদ সারাজীবন গান রচনা করেছেন মাত্র 206 টি। তার লেখা গান “কাকলি” “কয়েকটি গান” ও “গীতিগুচ্ছ” এই তিনটি বইয়ের সংকলিত হয়েছে। গানগুলিকে ভক্তিমূলক, দেশাত্মবোধক, ঋতু বিষয়ক ও অন্যান্য এই পর্যায়ে ভাগ করা যায়।

ভক্তিমূলকঃ- বানী, সুর, ভাব,‌ কাব্যমাধুর্, স্বকীয়তা এবং সহজ চলনে তার লেখা ভক্তিগীতিগুলি বাংলা গানের ভুবনে বিশিষ্ট হয়ে আছে। তাঁর ভক্তিমূলক গানের মধ্যে “কে গো তুমি বিরহীনি আমারে সম্ভাষিলে” গানটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য।

দেশাত্মবোধকঃ- অতুলপ্রসাদের লেখা বহু দেশাত্মবোধক গান চূড়ান্ত জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। যেমন- “উঠ গো ভারত-লক্ষ্মী” কিংবা “হও ধর্মেতে বীর হও কর্মেতে বীর”

ঋতু সংগীতঃ- অতুলপ্রসাদের বহুগানেই প্রকৃতি ও বিভিন্ন ঋতুর সমর্থক চিত্রায়ন রয়েছে। যেমন- “আইল আজি বসন্ত মরি মরি”

বিবিধঃ- অতুলপ্রসাদ বাউল, কীর্তন, রামপ্রসাদী, ভাটিয়ালি প্রভৃতিতে দেশজ সুরে অনেক চমৎকার গান রচনা করেন।

    সমালোচকদের মতে, তাঁর গা্নে স্বদেশ ও  মানব প্রেমের মূলে আছে ঈশ্বর প্রেম। রবীন্দ্রনাথ ও রজনীকান্ত ছাড়া আর কোন কবির গানে এরকম কোন দৃষ্টান্ত নেই। তাই বাংলা সঙ্গীতের ধারায় অতুলপ্রসাদ ভারতের মূল্যবান সম্পদ।

 

 Download Pdf